আমার বাবাঃ সুকেশ রঞ্জন বিশ্বাস ... টুকরো ছবিতে । সপ্তর্ষি বিশ্বাস
১।
কৈশোরের
কিনারায়, অবধারিত ভাবে, পাওয়া গেলো সচিত্র 'জীবন যৌবন', তোশকের আবডালে। খবর, সময়মতো,
পৌঁছল বাবার কাছে। ডাক পড়লো বাইরের কোঠায়। ছোটো তিনটি কোঠার বাড়ি হলেও বাড়িতে ঢুকেই
ডান দিকের কোঠাটি 'বাইরের কোঠা' আর সেই সঙ্গে 'বাবার কোঠা'ও বটে। সেখানে ডাকপড়ার অর্থ
যথেষ্টই 'গম্ভীর' - অন্ততঃ আট কেলাসে পাঠকালে।
বাবা কলেজ থেকে ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই। আমার ইস্কুল যাওয়া হয়নি অথবা ইস্কুল ছুটি ... মনেনেই। আবহে দুপুর। মনে আছে। বাইরের ঘরের তিনটি নিচু চেয়ারের একটিতে বাবা বসা। হাতে খবর কাগজ কিংবা কোনো বই। ঠিক মনে নেই।
আমার 'পাপ'এর সংখ্যা তখনই হাতে গোনা যায়না। তবে পর্নোগ্রাফি 'পাপ' টি নতুন। সুতরাং কি 'দন্ড' হবে নির্ধারিত কেজানে। গুটি গুটি পায়ে প্রবেশ করলাম মঞ্চে। বাবা পত্রিকা কিংবা বই থেকে চোখ না তুলেই বল্লোঃ 'ডি এইচ লরেন্সের নাম শুনেছিস'? ... অকালপক্কতা বশতঃ নামটি জানা ছিল। তাঁর 'স্নেক' আর 'পিয়ানো (?)' নামের দুটি কবিতা পড়েছিলাম। বাবারই ক্লাশে পড়ানোর কোনো বইয়ে। বল্লামঃ 'শুনেছি'।
"এই সমস্ত বই" ... সচিত্র 'জীবন যৌবন' টি নিচু টেবিলের নিচু তাক থেকে বার করে উপরে রেখে বাবা বল্লোঃ " ... পড়ার কোনো মানে হয়না। ডি এইচ লরেন্সের 'লেডি চ্যাটার্লীর লাভার', "হোয়াইট পিকক্" বা নভোকভের 'লোলিটা' পড়ে দেখ বরং। এই সমস্ত আর পড়িসনা ...। এই বই যার তাকে ফেরৎ দিয়ে আসিস।"
২।
শীতকাল এলেই
মা আর বাবার 'কথাবন্ধ' ঋতু আরম্ভ হতো। চলতো, খেপে খেপে, দিন পনেরো। হেতু, এখন বুঝি,
শীতকালে ঘর-কাজ করবার মাসি,দিদিরা বেপাত্তা হয়ে যেতেন। কাজের চাপ বেড়ে যেতো অতএব। কাজ
বলতে একদিকে অসুস্থ দিদিভাই, বাবার পিসী, যাঁর হাতে বাবার বড় হওয়া। আমারো, কিছুদূর।
অসুস্থ বাবু। আমার ঠাকুর্দার মামা। আমার বাবার পিতাতূল্য। সঙ্গে আমার নামে পাড়া প্রতিবেশীর
দৈনিক নালিশ। ... সমস্ত মিলেমিশে অবশেষে অবয়ব নিতো দাম্পত্য কলহে।
এমনি দাম্পত্য
কলহের 'কথাবন্ধ' পর্বে বাবা ফিরলো কলেজ থেকে। সন্ধ্যার দিকে। তখনো সাইকেল চালিয়ে কলেজে
যেতো বাবা। দেখলাম বাবার ক্যারিয়ারে এক গুচ্ছ বই। সেগুলি এনে রাখলো বাইরের কোঠায়। আলমারির
মাথায়। হ্যাঁ, দাম্পত্য কলহের প্রথম এবং তুঙ্গপর্বে বাবার বসবাস চলতো বাইরের কোঠাতেই। ওই সময় বাবাকে আমরাও একটু সমঝে চলতাম।
ফলে বাবা
এসে বইগুলি রেখে ভেতর বাড়ির দিকে না যাওয়া অব্দি অপেক্ষা করলাম। সুযোগ আসা মাত্র বই
গুলি নামালাম আর চমকে উঠলাম। 'দ্য লাইট হাউস এট্ দি এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড', 'এরাউন্ড
দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেইস্', 'গ্রেট এক্সপেকটেশন্স্' , "দ্য ম্যান হু লাফ্স",
"ইডিয়ট" ... আহ্ রঙ্গিন মলাটের, হার্ড বাইন্ডিং করা সেই অনুবাদগুলি ...
কয়েকটি সুধীন্দ্রনাথ রাহা'র, কয়েকটি নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের ... সে দেব সাহিত্য
কুটীর ... সেই ছয় কেলাস, প্রথম পরিচয় 'প্রিন্স মিশকিনে'র সঙ্গে ...। বইগুলি ওল্টাচ্ছি
পাল্টাচ্ছি আর ভুলেগেছি আবহ -- বাবা-মা'র 'গোঁসাপর্ব' যার ছাঁট, বৃষ্টির ছাঁটের মতো,
লাগে আমাদেরো গায়ে। তখুনি কলেজ-পোশাক পাল্টে বাবা ঢুকলো বাইরের কোঠায়। একটু ঘাবড়েই
গেলাম। কি মুডে আছে কেজানে।
কাঁপা কাঁপা
গলায় বল্লামঃ এই বইগুলো কার পড়ার জন্য এনেছো?
কেননা এমত
বই, আনা হতো আমারই পড়ার জন্য।
বাবা বল্লোঃ
"আমি পড়বো "
"এগুলো
তো বাংলা ট্রেনশ্লেশান। তুমি আসল গুলো ..."
একগুঁয়ে
বাচ্চার মতো জবাব দিলো বাবাঃ তবু আমি আবার পড়বো
"এখুনি
পড়বে?"
"না"
"তাহলে
তুমি পড়বার সময় নিয়ে নিয়ো... এখন আমি একটু পড়ি ..."
"ঠিক
আছে" ...
পরে, নিজেও
প্রবেশ করেছি দাম্পত্যে, দাম্পত্য-কলহের ছাঁট, দেখেছি কিভাবে পড়ে ছেলেমেয়েতে আর তখনই
মনেপড়েছে বাবার ঐ বলা, একগুঁয়ে বাচ্চার মতো ,"তবু আমি আবার পড়বো"...
আদতে পত্নীর
প্রতি অভিমানের, অভিযোগের প্রকাশ আমাকে দেখানো এই ছদ্ম গাম্ভীর্য যখন আদতে বইগুলি আনা
হয়েছিল আমার জন্যই...
৩।
আসতো বইএর
ফিরিওয়ালারা। সম্ভবতঃ দিল্লী থেকে। আসামের প্রত্যন্ত শহরের হাতেগোনা 'বই'বাসিন্দাদের
সামনে তারা যখন মেলে ধরতো রঙ বেরঙ্গের বইগুলি - নানা বিদেশী প্রকাশন সংস্থার ছাপা
- তখন তাদেরই মনে হতো দেবদূত। নানা বিষয়েয় এনসাইক্লোপেডিয়া ধরনের বা ম্যামথ্ বুক ধরনের
বই। ইতিহাস, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, রূপকাহিনী ... এমনই এক ফেরিওলা এসে হাজির হয়েছিল
যখন আমি ছয়ের কেলাসে যাই এবং পাঁচের কেলাস থেকে ছ'য়ের কেলাসে উঠেছি সবচে' কম নম্বর
পেয়ে... সব'চে কম নম্বর বলতে এই মফস্বলের যে সকল কলেজ-মাষ্টারের ছেলেরা আমার সমপাঠী
তাদের সবার চেয়ে কম আর যেহেতু এই সকল মফস্বলে একের বৌ'এর অন্যের সঙ্গে পালানো বা বড়
রকমের ডাকাতিও প্রায় ঘটেনা অতএব কাচ্চাবাচ্চার কেলাস ওয়ান থেকে কেলাস-অসীম অব্দি প্রাপ্ত
নম্বরের আলোচনা 'ভদ্র' সমাজে ছিল বিশেষ। আর আমার নম্বর যেহেতু বাকি দুই কলেজ-মাস্টর-পুত্রের
চেয়ে কম সুতরাং বাবার, বাবার ভাষাতে, 'মাথা নিচু' কমনরুমে। এহেন যখন অবস্থা তখনই সেই
বই-ফিরিওলা এসে হাজির। এসেই খুলে বসলো তার পেন্ডোরার বাক্স ... হান্স এন্ডারসনের সমগ্র
রূপকাহন, গল্পে-ছবিতে বিশ্ব ইতিহাস, ভূবিদ্যা- গল্পে, ছবিতে, সচিত্র ইংরেজি অভিধান
...। বাবাকে দেখাতে লাগলো বইগুলি। আমরা দুই ভাইও এসে দাঁড়ালাম। বাবা বল্লোঃ 'লেখাপড়ার
তো যা অবস্থা ... আবার এসব বই ..." ... বল্লো বটে, তবে বাবার চোখেও সেই মায়া যে
মায়া নিয়ে আমি দেখছি বইগুলি। সেই বয়সেও ওই মায়াকে চিনতে ভুল হয়নি বলেই সাহস করে বসলাম
কিনারে। হাতে নিলাম একটি বই, দুটি বই ... বাবা কি দেবে কিনে? যদি না দেয় ... ফলে যতোবেশী
সংখ্যক বই উল্টে যায় দেখে ফেলা ততোই মঙ্গল। পাগলের মতো গিলে ফেলবার চেষ্টার আবডালে
খেয়ালই করলাম না, যে, চারটি বই এর 'অর্ডার' দিয়ে ফেলেছে বাবা ...
মনেপড়ে বইগুলি'র
আসার দিনটি। স্পষ্ট। শরতের এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে সামান্য আগেই। দুপুর-দুপুর ভাবটা
ধুয়ে গিয়ে বিকালের আমেজ। বাবা সেদিন বাড়িতেই ছিল। এসে হাজির হলো অচেনা এক লোক। রিক্সা
চেপে। সঙ্গে কাঠের একটি বাক্স। এসে অবাঙ্গালো সুরে খোঁজ করলো বাবার। এই লোক বা এই বাক্সের
সঙ্গে যে সেই 'অর্ডার দেওয়া' বই এর কোনো সম্বন্ধ আছে তা ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করিনি আমরা
দুই ভাই। লোকটি ফিরে গেলো, একটি খাতায় না'কি কাগজে বাবার সই নিয়ে। বাক্স বারান্দার
রেখেই বাবা গেলো ভেতরে। ফিরে এলো একটা হাতুড়ি নিয়ে। অদ্ভুত দক্ষতায় খুলে ফেল্লো লোহাগুলি।
বার হয়ে এলো চারটি থান ইঁট মার্কা রঙ্গীন বইঃ হান্স এন্ডারসনের রূপকথা, বিশ্ব ইতিহাস,
ভূগোল আর সচিত্র অভিধান। ... ১৯৮১/৮২ সালের কথা। তখুনি এই সেত্টির দাম চিল আড়াই হাজার
টাকা আর তখনই আমাদের বাড়িটা উঠেছে সদ্য, কলেক কো অপারেটিভ থেকে লোন নিয়ে। মাসে মাসে
বেতন থেকে শোধ হচ্ছে লোন ...
এ সমস্তই
পরে জেনেছি। বুঝেছি আরোও পরে যখন বেসরকারী ব্যাংকের লোনে কিনতে বাধ্য হয়েছি খোপ ব্যাঙ্গালোর
নামের নষ্ট-নগরে...
বই-বাক্স
আসার সেই বিষ্টিধোয়া বিকালটি মনে আসে প্রায়ই। মনে আসেন হরিহর রায় ... দিনের ভাত না
জুটলেও অপু'র জন্য পত্রিকা আসতো, আসতোই, ডাকে। ... এই 'হরিহর রায়'হেন পিতারা আর নেই
যারা 'সাফল্য' বলতে ডলার-দিনার-স্টার্লিং এর কথা কখনো ভাবতেই পারেননি বরং সন্ততির সামনে
পৃথিবীর পথটাকেই চেয়েছেন খুলে দিতে ...
আজ ভাবি
আমার সদ্য প্রয়াত বাবা'ই কি এই সময়ের শেষ হরহর রায়?...
৪।
পাড়ার কয়েকজন
হাজির হলেন আর্জি নিয়ে। আসছেন শীর্ষেন্দু আর সুভাষ। আসছেন এক "বাবাজী" র
"আশ্রমে"। আশ্রমটি আমাদের পাড়াতেই। আর্জি এই, যে, এঁদের এনে বসানো হবে আমাদের
বাড়িতে - যেহেতু বাবা " শিক্ষিত " লোক তাই কথাবার্তা বলে, বাবার সংগে, তাঁরা
"বোর" হবেন না।... বারো কেলাসে নয়তো ইঞ্জিনিয়ারিং এর ১ম বর্ষ আমার। আব্দারটি
শুনলাম আমিও। শুনতে শুনতেই ভাবছিলাম, যে, উভয়েই আমার প্রিয় লেখক ও কবি। শীর্ষেন্দু,
বাবার, বিশেষ করে। তবু এঁরা "বাবাজী" ভজনায় এসে আমাদের বাড়িতে... আমাদের
তো কোনো "বাবাজী বায়াস" নেই.. তখুনি
বাবা বল্লোঃ দেখুন, ওই দুইজন মানুষকেই আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি স্রষ্টা হিসাবে। এঁরা
আমার অতিথি হবেন - এ আমার পরম সৌভাগ্য হতো যদি এঁরা এমনি এই শহরে বেড়াতে আসতেন কিংবা
আসতেন সাহিত্য সংক্রান্ত কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। কিন্তু এঁরা ত আসছেন "বাবাজীভোজে"...
সুতরাং শিক্ষিত - অশিক্ষিত যেমনই হোক, কোনো " বাবাজীভক্ত"ই তাঁদের এ যাত্রার
দায়টি নিন বা অন্য কোনো "শিক্ষিত" যদি রাজি থাকেন... আমাকে মাপ করবেন.. "
হ্যাঁ এই
যে ঔদ্ধত্য, যার মর্মে নিহিত নিজস্ব বিশ্বাসে
দাঁড়িয়ে থাকবার দুঃসাহস তাকে সেলাম, লালসেলাম।... এই প্রত্যন্ত মফস্বলে "শীর্ষেন্দু
- সুভাষ " এর গা কয়েকঘন্টার জন্য হলেও ঘেঁষে থাকবার সুযোগ.. আহা.. কজন পারতো,
পারে, প্রত্যাখ্যান করতে, আমি জানিনা। কিন্তু এই ঔদ্ধত্যে, প্রত্যাখ্যানে বাবা আমাকে
আর আমার ভাইকে যে পরোক্ষ শিক্ষা এবং সাহস দিলো আমরা তার যোগ্য কিনা জানিনা তবে এই বাপের
ব্যাটা হয়ে আমরা গর্বিত ত বটেই।