Tuesday, October 26, 2021

চিঠি, “বিদেশী” বন্ধুকে

চিঠি, “বিদেশী” বন্ধুকে

 


 

ভাই বাপ্পাদিত্য,

শেষ পর্যন্ত বাবা’র যোগ দেওয়া হলোনা এই বছর, আপনাদের অনুষ্ঠানে, মূলতঃ দ্রুত-পাসপোর্ট না পাওয়ার মূল্যে। অথচ যে দেশ থেকে আমন্ত্রণ এলো সেই দেশেই জন্ম আমার বাবার, আমার মা’র।  তাঁদের বাবার, মা’র। তাঁদেরো পূর্বজদের।   Assam Legislative Assembly - MLA 1937-46 ‘র ওয়েব পাতা (http://assamassembly.gov.in/mla-1937-46.html)খুললে দেখতে পাচ্ছি তার ৫২ তম নামটি ‘বাবু শিবেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস, হবিগঞ্জ নর্থ। - এই শিবেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস, হন, পিতামহ, আমার পিতার। কিন্তু ঠিক কোন সালে তিনি MLA হয়েছিলেন  বা কতো বৎসর ছিলেন ঐ পদে সেই সব তথ্য অদ্যাপি আমার অজানা।  অতঃপর উইকিপেডিয়াতে (https://en.wikipedia.org/wiki/1950_East_Pakistan_riots)  দেখতে পাচ্ছি  On 11 March, Suresh Chandra Biswas, a Member of Legislative Assembly (M.L.A.) of East Bengal from Sylhet was arrested for addressing a public gathering where he protested against the arson on Hindu houses. Biswas was belabored, handcuffed and paraded through the streets and locked up. A charge of arson was framed against him and he was imprisoned. [38]” – এই সুরেশ চন্দ্র বিশ্বাস আমার মাতামহ। অর্থাৎ তিনি, হন, পিতা আমার মাতার। অথচ এই মানুষদেরই একটি নদী মাত্র পার হতে দেওয়া হয়না, যায়না সরকারি অনুমতি ছাড়া, পাসপোর্ট ছাড়া। হয়না, কেননা, ভাষিক, জাতিক – সমূহ প্রকারের আগ্রাসনই মূলতঃ জীবনের অন্তর্গত চলিষ্ণুতার শত্রু।  এই মুহুর্তে ভারতবর্ষ নামক ভূখন্ডে, বলা উচিত খন্ডিত ভূখন্ডে ‘নাগরিকত্ব’ নিয়ে যে প্রহসন আরম্ভ হয়েছে, পুনরায়, এ’ও সেই আগ্রাসনের আরেক চেহারা – যে চেহারা আমরা দেখেছি ৪৭’এ, ষাটের দশকে, আশির দশকে আসামে, সত্তরের দশকে বাংলাদেশে।

 

 

 

                                              বৃদ্ধ পিতামহ শিবেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাসের পরিচয়ের কিছুটা পরে পেয়েছি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের আত্নজীবনিতে। একই গ্রন্থে রয়েছে আমার পিতামহ শ্রী শক্তিকেশ বিশ্বাসের কথাও। সেই গ্রন্থেই রয়েছে মাতামহ সুরেশ চন্দ্র বিশ্বাসের কথা। তাঁদের জীবৎকালের অনেকগুলি বছরই কেটেছে জেলে জেলে।  সুতরাং আমার পিতা শ্রী সুকেশ রঞ্জন বিশ্বাস আর মাতা শ্রীমতী শিবানী বিশ্বাসের শোণিতে যে মিশে থাকবে প্রতিবাদী লোহিত কণিকা, জন্মসূত্রেই, তা’তে আর আশ্চর্য কি?

       আসামের বাঙ্গালীর যে ভাষা আন্দোলন তার ইতিহাস বিস্তৃত, বিচিত্র ও জটিল তবে তার অন্তর্গত দ্বন্দ্বের মূলসূত্র আর সমস্ত আগ্রাসনের অন্তর্গত সত্যেরই সহোদর।  এর ইতিহাস, এর বিশ্লেষণ – আমার মেধাক্ষমতার বাইরে। বাবা কিংবা মা নিজে এলে নিশ্চয় কিছু বলতে পারতেন। আমি শুধু বলার চেষ্টা করব বাবা-মা’র মুখে শোনা তাঁদের অভিজ্ঞতার, অংশ গ্রহনের কাহনটুকুই।

 

 

 

                     অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের জবানীতে “নতুন দেশে নতুন জিনিস, মানুষ নয়, জিনিস। নতুন জিনিসের নতুন নাম ‘উদ্বাস্ত’ ‘ – নিয়ে যখন সুকেশ রঞ্জন আর শিবাণীর পরিবার দুটি শিলচরে এসে ভারতীয় হল, সেই ৫০-৫১ সাল নাগাদ,  তখন দুটি পরিবারই আর নব্বই ভাগ ‘উদ্বাস্তু’ পরিবারের মতোই নিম্ন মধ্যবিত্ত। আমি দেখিনি আমার পিতামহ শক্তিকেশ বিশ্বাসকে। আমার বাবার বয়স যখন তেরো বৎসর তখনি গত হয়েছিলেন পিতামহ। পিতৃ বিয়োগের পরে যাঁর কাছে বাবা ফিরে পেয়েছেন সেই হৃত পিতৃস্নেহ তাঁরো নাম শিবেন্দ্র। শিবেন্দ্র চক্রবর্তী। গায়ক। গানের শিক্ষক। শিলচরে যিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘মহুয়া’ নামের সাংস্কৃতিক সংস্থা। সম্পর্ক বলতে এই শিবেন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন শ্যালক, অতি নামমাত্র সম্পর্কে, আমার বাবার পিতামহ  শিবেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাসের। আর ছিলেন, আমার বাবার মা’র ভূমিকায়, বাবার পিসী , শিশিরকণা বিশ্বাস। বাল্য বিবাহের শিকার। স্বামীদ্বারা পরিত্যক্তা। বাপ-ভাই’এর সঙ্গে ‘দেশের কাজ’ করা এক আশ্চর্য মহিলা । আমার বাব সুকেশ রঞ্জন বিশ্বাসের জন্ম ১৯৩৯ সালে, মা শিবাণী বিশ্বাসের ১৯৪১ এ। সুতরাং ১৯৫২-৫৩ সালে তাঁদের বালক-বালিকা জীবনকে দাঁড় করিয়ে রেখে, সময় এবং অনুষঙ্গের প্রয়োজনে চলে আসা যাক ১৯৫৯ সালে। আসামের শিলচর শহরে। নিচু মতন টিলার উপরে ছড়িয়ে থাকা গুরুচরণ কলেজে। ১৯৫৯ সালে গুরুচরণ কলেজে ছাত্র সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি হয়েছেন সুকেশ। খুবই কম ভোটে সুকেশের কাছে হেরে গিয়েছেন শিবাণী। আগের বৎসর এই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন সুবিমল চৌধুরি। সুবিমল চৌধুরি আর সুকেশ রঞ্জন প্রতিবেশী এবং বন্ধু। এতদ্‌ভিন্ম তাঁদের দুই জনেরই রাজনৈতিক “মেন্টর” তখন শ্রী নরেশ চন্দ্র ভৌমিক। নরেশ চন্দ্র ভৌমিকের রাজনৈতিক ভাবধারার মূল সুরটি ছিল রাম মনোহত লোহিয়ার ‘সোসালিস্ট কংগ্রেসের” সুরে বাঁধা। পরবর্তীতে, আসামের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই কারাবরণ করেন শ্রী নরেশ চন্দ্র ভৌমিকও।  এবার কল্পনায় এঁকে নিতে হবে একটি স্কেচ, শিলচর শহরের যার এক প্রান্ত দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদি বরাক, ১৯৫৯- ৬০ সালে বরাকের বুকের ওপরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়নি কোনো কাঁচা বা পাকা ব্রিজ। “ওরিয়েন্টাল” নামের প্রেক্ষাগৃহের নাম তখন “ওরিয়েন্টাল টকিজ” বরাকের ফেরিঘাটে ভিড়তে চেষ্টা নিচ্ছে নৌকা, “পানসী নাও” , পানসীতে ক’রে পার লাগতে চাইছেন মন্ত্রী সিদ্ধিনাথ শর্মা আর ফেরীঘাট ভরা জনতা, মূলতঃ ছাত্ররাই, মন্ত্রীর দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে জুতো, দোলাচ্ছে কালো পতাকা, হাঁকছে শ্লোগান। পুলিশে মিলিটারিতে ছয়লাপ ফেরীঘাট। তথাপি তিলমাত্র ফাটল ধরছেনা এই অবলীল ব্যারীকেডে। বাধ্য হয়ে ফিরেযাচ্ছে মন্ত্রী মহোদয়ের পানসী। ফিরে যাচ্ছে কেননা বরাক উপত্যকার বঙ্গভাষী জনতা প্রতিবাদ করছে বিমলা প্রসাদ চালিহা’র আনা ভাষা ‘বিল’ এর – যে বিল ওসমীয়া ভাষাকে ঠুসে দিচ্ছে বাঙ্গালী জনতার মুখে ঠিক যেমন একদা ঘটেছিল পাকিস্তানে। - এই প্রতিবাদে উত্তাল জনতার মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি সুকেশ রঞ্জন এবং শিবাণী উভয়কেই। - অর্থাৎ, এইভাবেই, ছাত্র রাজনীতির সূত্রে সুকেশ রঞ্জন বিশ্বাস আর শিবানী বিশ্বাসের জড়িয়ে পরা ষাটের দশকের বাঙ্গালীর ভাষা আন্দোলনে, অসমীয়া উগ্র জাতীয়তার বিপক্ষে। ছাত্রছাত্রীরা কালো পতাকার প্রতিবাদ জানিয়েছে আসামের তৎকালীন গভর্ণর শ্রীনাগেশকে।

                           আসামের যে অংশকে বলা হয় ‘আপার আসাম’,  সেখানে, এদ্দিনে আরম্ভ হয়ে গিয়েছে ‘বঙ্গাল খেদা’র বেনামী ‘আন্দোলন’। ডিব্রগড় মেডিকেল কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে ছয়জন বাঙ্গালী ছাত্রকে। সেই ছয় জন ছাত্রকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে স্থান দেওয়ার আর্জিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় কে  মেমোরেন্ডাম  দিতে কলকাতা হাজির হতে হয়েছে সবান্ধব সুকেশ রঞ্জনকে। কলকাতায় সুকেশ্রঞ্জন সাক্ষাৎ করলেন শ্রী ত্রিগুণা সেনের সঙ্গে। মূলতঃ শ্রীহট্টিয় এই শিক্ষাবীদ তথা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সহ্নেহ প্রশ্রয়ে তাঁদের লিখিত মেমোরেন্ডামটি পাঠ করলেন এবং স্বহস্থে পরিমার্জন করে দিলেন সেই মেমোরেন্ডাম। বাবার কথা’য় সস্নেহ প্রশ্রয় তাঁরা পেয়েছিলেন শ্রী বিধান চন্দ্র রায়ের কাছেও। সেই ছয় জন বাঙ্গালী ছাত্রকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করবার ব্যবস্থা করেছিলেন বিধান রায়।

বাঙ্গালো ছাত্রদের উপর এই নির্যাতন, আসামের বাঙ্গালী অধ্যুষিত অঞ্চলে অসমীয়া ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া – এ’ই সমস্ত উগ্র জাতীয়তাবাদী কীর্তি

মূলতঃ অনসমীয়া জনগনকে উৎখাত এবং হত্যা’র মাধ্যমে তাদের জমি-বাড়ি-মেহনত সমস্তকেই নিজেদের হতগত করাই ওই “আন্দোলন”এর কেন্দ্র, চাপ, পরিধি, ব্যাসার্ধ – সকলি। “খেদা” খেয়ে, জান হাতে করে এসেছে জনতা “লোয়ার আসাম”এ। শিলচরে, করিমগঞ্জে।  শিলচরে এঁদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে ‘শিলচর নর্ম্যাল কলেজ’, ‘গুরুচরণ কলেজ’ আর ‘অভয়াচরণ পাঠাশালা’য়।

সিদ্ধিনাথ শর্মা মহোদয়ের ‘পানসী’কে ফেরীঘাটে ভিড়তে না দেওয়া এই আন্দোলনের একটি সাফল্য তো বটেই। কিন্তু এ’র মূল্যে কারাবরণ করতে হয়েছিল অনেক ছাত্রনেতা, ছাত্রনেত্রী, আন্দোলনকারী সহ অনেককেই। তিনিদিন তিন রাত্রির কারাবাস জুটেছিল শ্রী সুকেশ রঞ্জন বিশ্বাসেরও। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় শিলচর শহরের কেন্দ্রস্থিত পার্ক “গান্ধীবাগের” নিকটস্থল থেকে। প্রতিবাদ-শেষে বাড়িফেরা পথে শ্রীমতী শিবাণী বিশ্বাস ও তাঁর বান্ধবীদের তাড়া করেছিল সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী।

শ্রী সুকেশ রঞ্জন বিশ্বাস ও শ্রীমতী শিবাণী বিশ্বাসের কথায়ঃ “সেই সময়ের আগে কোনো ছাত্রসংঠন ছিল না। ভাষাসংগ্রামের প্রেক্ষিতেই “ছাত্র সমিতি” গঠন করা হয়। বিশেষ কোনো পার্টির এখানে উল্লেখ করা যাবেনা সকলে মিলেই এই আন্দোলন  গড়ে উঠেছিলো। মূলত  স্থানীয় আবেগটাই ছিল প্রধান অন্তর্বস্তু”। “ছাত্র সমিতি”র সেক্রেটারি ছিলেন সুকেশ্ রঞ্জন। শ্রীমতী শিবাণী ছিলেন “ছাত্র সমিতি”র ‘ভাইস্‌ প্রেসিডেন্ট”।  বরাক উপত্যকায় অসমীয়া ভাষা আইন আর ‘বঙ্গালখেদা’র বিপক্ষে প্রতিবাদের তীব্রতার বৃদ্ধির সমান্তরালে স্বাভাবিকভাবেই তীব্রতর হচ্ছিল  আগ্রাসন। পরিষ্কার হয়ে উঠছিল উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদের ‘নাজি’ চরিত্র। এই ভাবেই একদিন এসে পরেছিল সেই রক্তাক্ত দিন। ১৯ শে মে ১৯৬১। ১৯শে মে’ নামক ওয়েব পাতার থেকে উদ্ধৃত করছি ১৯ শে মে’স চুম্বক কথাঃ “... সেবার সারা পৃথিবী যখন বিশ্বকবির জন্মশতবর্ষ উদযাপন সমারোহে ব্যস্ত, তখন বরাক নদীর দুপারে চলছিল কবিগুরুর ভাষায় কথা বলার, গান গাইবার, জীবন সাধার অধিকার অর্জনের লড়াই। কবিপক্ষেই আসামের বরাক উপত্যকার তৎকালীন অবিভক্ত কাছাড় জেলার সদর শহর শিলচরের রেল স্টেশনে পুলিসের গুলিতে জীবন আহুতি দিয়েছিল ১১ জন তরুণ তরুণী। রক্তদানের পুণ্যে অর্জিত হয়েছিল বরাক উপত্যকার তিনটি জেলার জন্যে সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি। সেদিন বাংলা ভাষার অধিকার অর্জনের লড়াই শুধুমাত্র বাঙালির লড়াই ছিল না। বাংলা ও বাঙালি ছিল অগ্রভাগে, কিন্তু লড়াই ছিল বহুত্বের স্বপক্ষে বহুভাষী মানুষের লড়াই। ১৯ মে’র গুলিচালনার প্রতিবাদ করে আসাম বিধানসভা থেকে প্রথম যিনি পদত্যাগ করেন, তিনি নন্দকিশোর সিংহ। ভাষিক পরিচয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি। শিলং শহরে ঐতিহাসিক মৌনমিছিল করেছিলেন খাসি পুরুষ রমণীরা। এই বহুত্বের চেতনাই উনিশের চেতনা। বহুভাষিক আসামে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকারের সংগ্রামই ছিল সেদিনের বাংলা ভাষা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য। উগ্র জাতিদম্ভের বিরুদ্ধে বহুত্বের লড়াই ১৯৬১ সালের পর এগিয়ে গেছে ১৯৭২ সাল হয়ে ১৯৮৬ ও ১৯৯৫ সালেও। ১১ জন তরুণ তরুণীর রক্তচিহ্ন লাঞ্ছিত পথ ধরে শহীদত্বের পথে যোগ দিয়েছেন করিমগঞ্জে ১৯৭২ সালে বাচ্চু চক্রবর্তী ও ১৯৮৬ সালে জগন (জগন্ময় দেব) ও যীশু (দিব্যেন্দু দাস)। রক্তদানের একই ধারায় যুক্ত হয়েছেন ১৯৯৫ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি ভাষার সংগ্রামে কলকলিঘাটে বীরাঙ্গনা সুদেষ্ণা সিনহা। আমাদের ইতিহাস ও ভূগোল পরস্পর দ্বন্দ্বযুদ্ধে মেতে আছে সেই কবে থেকে। ফলেই আমাদের গানে ছবিতে সাহিত্যে আমাদের জীবনধারায় এক চিরন্তন বিরহগাথা,এক অনিঃশেষ দীর্ঘশ্বাস। প্রত্যন্তের নিভৃতিতে একান্তে বেজে চলা আমাদের বাঁশির সুর এখনো বহির্বিশ্বে প্রায় অশ্রুতই ...”

১৯৬১’র ১৯ শে মে গুলি যে চলবেই তা সম্ভবতঃ নির্ধারিত হয়েছিল অনেক আগে থেকেই।  শ্রীমতী শিবাণী বিশ্বাসের ভগ্নীপতি তখন আসাম পুলিশের “এস আর পি”।  সরকারী আবাসনে সস্ত্রীক তিনি বাস করেন, তখন, আসামের হাফলং নামের পাহাড়ি শহরে। ১৭ কিংবা ১৮ মে সেই ভগ্নীপতি এসে হাজির হলেন শিবাণীর পিতৃগৃহে। “দিদি সাংঘাতিক ভাবে অসুস্থ” – এই বয়ানে শ্যালিকাকে রাজি করালেন তাঁর সঙ্গে হাফলং আসতে। কাক ভোরের রেলগাড়িতে, তখন, পুলিশ বিভাগের যে বিশেষ “সেলুন” থাকতো তা’তে করে যাত্রা শুরু হল শিবাণী, তাঁর খুড়তুতো বোন ও ছোটভাই’এর, হাফলং  শহর অভিমুখে। বদরপুর জংশনে সেই সেলুনে সেই ‘জামাইবাবু’টি তাঁর নিজের ‘বড় সাহেব’ লালা বি কে দে’কে কে ডেকে এনে শ্যালক-শ্যালিকাদের সঙ্গে পরিচয় করানোয় আবডালে জানিয়ে দিলেন, যে, তাঁর শ্যালকাকে তিনি সড়িয়ে নিচ্ছেন ঘটনাস্থল থেকে

     ১৯৬১সালের ১৯শে মে যখন ভিজে উঠলো বাঙ্গালীর তাজা রক্তে  শিবানী তখন হাফলঙ্গে। ২০ না’কি ২১ মে’তে সংবাদটি পৌঁছেছিল তাঁর কাছে। খবর পাওয়ামাত্রই তিনি চেপে বসেছিলেন শিলচরের ট্রেনে। শিলচরে নেমে সোজা চলে এসেছিলেন সরকারি হাসপাতালে যেখানে আহতদের চিকিৎসা চলছে, হতদের লুকিয়ে রাখা হয়েছে মর্গে, হতাহতদের আত্মিয় পরিজনদের উপরে চলছে পুলিশি হেনস্থা। ক্রমে  কারফিউ ঘোষিত হলো শহরে। আর সেই কারফিউ’র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ জানালেন গুরুচরণ কলেজের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শ্রী যোগেন্দ্র চৌধুরি।  কিন্তু এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে জনতার, নেহাতই “আম্‌" যে জনতা, তার নিরস্ত্র কিন্তু স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিরোধে ‘নাজি’রাও ভীত হয়ে পরেছিল। ঈশ্বরের নিজস্ব সন্ততি যে সরকারি পুলিশ তারাও পুলিশি পোষাকে জনসমক্ষে আসতে সাহস করেনি অনেক দিন। হাটে বাজারে এসেছে গিয়েছে ‘সিভিল ড্রেস’এ।

 ছাত্র সমিতি”র পক্ষ থেকে স্থির হলো যাওয়া হবে কলকাতা । সাক্ষাৎ করতে হবে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে। প্রয়োজনে যেতে হবে দিল্লীতেও। বরাক উপত্যকা জুড়ে সে সম্মিলিত সংগ্রাম সমিতি গড়ে উঠেছিল তার এক মুখ্য চিন্তক ও নেতা ছিলেন শ্রী বিধুভূষণ চৌধুরী’। ‘যুগশক্তি’ নামের সাময়িকপত্রের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন শ্রীহট্টের শ্রীদিগেন্দ্রনাথ দেব ।১৯৪৬ সালে তাতে কর্মী হিসেবে যোগদান করলেন প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা শিক্ষক বিধুভূষণ চৌধুরী। ১৯৪৭ থেকে, করিমগঞ্জে এই পত্রিকা লালিত হয়েছে বিধুভূষণ চৌধুরী’র দ্বারাই মূলতঃ। সবান্ধব সুকেশ রঞ্জন এসেছিলেন করিমগঞ্জ, সম্মিলিত সংগ্রাম সমিতির সঙ্গে আলোচনার নিমিত্ত। রাতিবাস, তাঁদের , হয়েছিল শ্রী বিধুভূষণ চৌধুরী’র গৃহে। শ্রী বিধুভূষণ চৌধুরী’র পুত্রেরাও সবাক ছিলেন এই আন্দোলনের করিমগঞ্জ মানচিত্রে। আমার বাবার সমসাময়িক ছিলেন সুজিৎ চৌধুরি। আমার সৌভাগ্য এই, যে, তাঁর মৃত্যু অবধি, তাঁর স্নেহসান্নিধ্য আমি পেয়েছি।

     এই সমস্ত পরিকল্পনা যখন চলছেসংগ্রামকারী ও সংগ্রাম-সমর্থকদের মধ্যে, তখন আপাত স্তব্ধ হয়ে থাকা আগ্রাসন যন্ত্র কিন্তু অন্দরে আয়োজন করছে বিপুল ঝড়ের যে ঝড় অচিরেই নেমে এলো, সমগ্র বরাক উপত্যকা জুড়ে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অবয়বে

সেই ঝড়ের দিনরাত্রিগুলির কথা আর মনে আনতে চান না  শ্রী সুকেশ রঞ্জন বিশ্বাস,  না’ত তাঁর স্ত্রী শিবানী বিশ্বাস। সেই নির্মীত ধূলিঝড়ের আবডালে মাঠে নামলো গন্ধ মূষিকেরা। দৌড়ে এলো শৃগালের দল। নেমে এলো শকুনেরা।  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা স্বাবাবিক নিয়মেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে অন্ধকারের প্রলেপ দিল জনচক্ষে। তবু কিছু মানুষের প্রাণ আর ত্যাগের মূল্যে অসমীয়া আগ্রাসন সাময়িক ব্যর্থ হল বরাক উপত্যকায়।

      আমার জ্ঞান হওয়ার পর বাবাকে দেখেছি বামপন্থী রাজনীতির কখনো সমর্থক, কখনো সক্রিয় ভূমিকায়। মা মূলতঃ সামাজিক সেবা মূলক কাজ আর তারই অঙ্গ হিসেবে নিজের বাংলা “মিডিয়াম” ইস্কুল নিয়ে আপনাকে আপনি ন্যস্ত হয়ে আছেন। - আপনাদের এই নিমন্ত্রণ পেয়ে যার পরনাই আনন্দিত বাবা, মা উভয়েই আর অন্তিমে পাসপোর্ট না পাওয়ায় সমান মর্মাহতও বটে। কিন্তু এ’ও তো সত্য, যে, বাংলা ভাষাকে কেন্দ্রে রেখে পৃথিবীময় যতো আন্দোলন, রক্তপাত – তাঁরাও যে এর শরিক এই কথা পৃথিবী ভোলেনি।

 

ধন্যবাদান্তে

সপ্তর্ষি বিশ্বাস, ১৮ই ফেব্রুয়ারী ২০২০

বেঙ্গালোর